ক্ষুদ্রান্ত্রে খাদ্য পরিপাক (Degestion of Food in Small Intestine)
পাকস্থলির পাইলোরিক
স্ফিংক্টারের পর থেকে বৃহদন্ত্রের সূচনায় ইলিওকোলিক স্ফিংক্টার পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায়
৬-৭ মিটার লম্বা, পাচানো অংশকে ক্ষুদ্রান্ত্র বলে। ক্ষুদ্রান্ত্র তিনটি অংশে বিভক্ত
যথা-ডিওডেনাম, জেজুনাম এবং ইলিয়াম। ডিওডেনাম হচ্ছে ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রথম অংশ যা দেখতে
U এর মত ও ২৫-৩০ সেন্টিমিটার লম্বা। জেজুনাম মধ্যাংশ লম্বায় আড়াই মিটার। শেষ অংশটি
ইলিয়াম যা ক্ষুদ্রান্ত্রের তিন পঞ্চমাংশ গঠন করে।
সব ধরনের খাদ্যের চূড়ান্ত
পরিপাক ক্ষুদ্রান্ত্রেই সংঘটিত হয়। খাদ্যের উপর তিন ধরনের রস যেমন-পিত্তরস, অগ্ন্যাশয়
রস ও আন্ত্রিক রস ক্রিয়া করে।
যান্ত্রিক পরিপাকঃ
·
আন্ত্রিক রসের মিউসিনের ক্রিয়ায় ক্ষুদ্রান্ত্রের মধ্যস্থিত খাদ্যস্তু
পিচ্ছিল হয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হয়।
·
ব্রুনার্স গ্রন্থি ও গবলেট কোষ থেকে মিউকাস তৈরি হয়। মিউকাস ক্ষুদ্রান্ত্রের
প্রাচিরকে এনজাইমের কার্যকরিতা থেকে রক্ষা করে।
·
পিত্তরস পরোক্ষভাবে অন্ত্রে জীবানুর কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
·
পিত্তলবনগুলো ক্ষুদ্রান্ত্রের পেশির ক্রমসংকোচন বাড়িয়ে বৃহদন্ত্রের
দিকে খাদ্যের গতি বৃদ্ধি করে।
·
কোলিসিস্টোকাইনিন নামক হরমোন পিত্তাশয়ের সংকোচন ঘটিয়ে পিত্তাশয়ে
সঞ্চিত পিত্তরস ক্ষুদ্রান্ত্রে পৌছে দেয়।
·
পিত্তলবন স্নেহদ্রব্যকে অবদ্রবনের মাধ্যমে সাবানের ফেনার মতো ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র কনায় পরিনত করে।
রাসায়নিক পরিপাকঃ
পাকস্থলি থেকে আগত অম্লীয়
কাইম অর্ধ্ব পরিপাককৃত শর্করা ও আমিষ এবং প্রায় অপরিপাককৃত স্নেহদ্রব্য নিয়ে গঠিত।
কাইম ক্ষুদ্রান্ত্রের গহ্বরে পৌছালে অন্ত্রের প্রাচীর থেকে এন্টেরোকাইনিন, সিক্রেটিন
এবং কোলেসিস্টোকাইনিন নামক হরমোন ক্ষরিত হয়। এসব হরমোনের প্রভাবে পিত্তথলি, অগ্ন্যাশয়
ও আন্ত্রিক গ্রন্থি থেকে যথাক্রমে পিত্তরস, অগ্ন্যাশয় রস ও আন্ত্রিক রস নিঃসৃত হয়।
পিত্তরস ক্ষার জাতীয়
তরল পদার্থ। এতে কোন এনজাইম থাকে না। পিত্তরসের সোডিয়াম বাইকার্বোনেট উপাদানটি পাকস্থলি
থেকে আগত Hcl কে প্রশমিত করে অন্ত্রের অভ্যন্তরে একটি ক্ষারীয় মাধ্যম তৈরি করে যা ক্ষুদ্রান্ত্রে
বিভিন্ন এনজাইমের কার্যকারিতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন।
শর্করা পরিপাক: অগ্ন্যাশয়
থেকে নিঃসৃত রসে শর্করা পরিপাকের জন্য নিচে বর্ণিত এনজাইম ক্রিয়া করে।
১. অ্যামাইলেজ এনজাইম
স্টার্চ ও গ্লাইকোজেন জাতীয় জটিল শর্করাকে মল্টোজে পরিণত করে।
২. মল্টোজ এনজাইম মল্টোজ
জাতীয় শর্করাকে গ্লুকোজে পরিণত করে।
আন্ত্রিক রসে শর্করা
জাতীয় খাদ্য পরিপাককারী নিম্নলিখিত এনজাইম ক্রিয়া করে:
১. আন্ত্রিক অ্যামাইলেজ
স্টার্চ, ডেক্সট্রিন প্রভৃতি পলিস্যাকারাইডকে আর্দ্রবিশ্লিষ্ট করে মল্টোজ, মল্টোট্রায়োজ
ও ডেক্সট্রিন উৎপন্ন করে।
২. আইসোমল্টেজ এনজাইম
আইসোমল্টোজ জাতীয় শর্করাকে আর্দ্রবিশ্লিষ্ট করে মল্টোজ ও গ্লুকোজ উৎপন্ন করে।
৩. মল্টোজ এনজাইম মল্টোজকে
বিশ্লিষ্ট করে গ্লুকোজ তৈরি করে।
৪. সুক্রেজ এনজাইম সুক্রোজ
নামক ডাইস্যাকারাইডকে ভেঙ্গে এক অণূ গ্লুকোজ ও এক অণু ফ্রুক্টোজ সৃষ্টি করে।
৫. ল্যাক্টেজ এনজাইম
দুধের ল্যাক্টোজ নামক ডাই স্যাকারাইডকে ভেঙ্গে এক অণু গ্লুকোজ ও এক অণূ গ্যালাক্টোজ
পরিণত করে।
আমিষ পরিপাক: অগ্ন্যাশয়
রসে অবস্থিত এনজাইমসমূহ আমিষ জাতীয় খাদ্যের উপর নিম্নরুপ ক্রিয়া করে।
১. ট্রিপসিন এনজাইম
নিষ্ক্রিয় ট্রিপসিনোজেনরূপে ক্ষরিত হয়। ডিওযেনামের মিউকোসা নি:সৃত এন্টোরোকটিন এনজাইমের
সহায়তায় এটি সক্রিয় ট্রিপসিনে পরিনত হয়। ট্রিপসিন প্রোটিওজ ও পেপটোন জাতীয় আমিষকে পলিপেপটাইডে
পরিনত করে।
২.কাইমোট্রিপসিন নিষ্ক্রিয়
কাইমোট্রিপসিনোজেনরূপে ক্ষরিত হয়। পরে ট্রিপসিনের ক্রিয়ায় এটি সক্রিয় কাইমোট্রিপসিনে
পরিনত হয়। এটি প্রোটিওজ ও পেপটোনকে ভেঙ্গে পলিপেপটাইডে পরিনত হয়।
৩. কার্বোক্সিপেপটাইডেজ
এনজাইম পলিপেপটাইডের প্রান্তীয় লিঙ্কেজকে সরল পেপটাইড অ্যামিনো এসিডে রূপান্তরিত করে।
৪. অ্যামিনোপেপটাইডেজ
এনজাইম পলিপেপটাইডকে ভেঙ্গে অ্যামিনো এসিডে পরিনত করে।
৫. ট্রাইপেপটাইডেজ এনজাইম
ট্রাইপেপটাইডকে অ্যামিনো এসিডে পরিনত করে।
৬. ডাইপেপটাইডেজ এনজাইম
ডাইপেপটাইডকে অ্যামিনো এসিড পরিনত করে।
৭. কোলাজিনেজ এনজাইম
মাছ ও মাংসে বিদ্যমান কোলাজেন জাতীয় প্রোটিনকে সরল পেপটাইডে রূপান্তরিত করে।
৮. ইলাস্টেজ এনজাইম
যোজক টিস্যুর প্রোটিন ইলাস্টিনকে ভেঙ্গে পেপটাইড উৎপন্ন করে।
আন্ত্রিক রসে আমিষ পরিপাককারী
এনজাইম অ্যামিনোপেপটাইডেজ পলিপেপটাইডকে অ্যামিনো এসিডে পরিনত করে।
স্নেহ পরিপাক:
স্নেহ পরিপাকে পিত্তরস
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পিত্তরসে কোন এনজাইম থাকে না। পিত্তরসে বিদ্যমান পিত্তলবন
সোডিয়াম গ্লাইকোকোলেট ও সোডিয়াম টরোকোলেট স্নেহ জাতীয় খাদ্যকে ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
কনায় পরিনত করে। এ প্রক্রিয়াকে অবদ্রবন বলে।
অগ্ন্যাশয় রসে স্নেহজাতীয়
খাদ্র বা ফ্যাট পরিপাককারী এনজাইম স্নেহকনাকে নিম্নরূপে পরিপাক করে-
১. লাইপেজ নামের এনজাইম
স্নেহকনাকে ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারলে পরিনত করে।
২. ফসফোলাইপেজ এনজাইম
ফসফোলিপিডকে ফ্যাটি এসিড, গ্লিসারল ও ফসফোরিক এসিডে পরিনত করে।
৩. কোলেস্টেরল এস্টারেজ
এনজাইম কোলেস্টেরল এস্টারের উপর ক্রিয়া করে ফ্যাটি এসিড ও কোলেস্টেরল উৎপন্ন করে।
আন্ত্রিক রসে নিম্নলিখিত
স্নেহ পরিপাককারী এনজাইম ক্রিয়া করে:
১. লাইপেজ এনজাইম পিত্তলবনের
প্রভাবে স্নেহকনায় পরিনত হওয়া লিপিডকে আর্দ্রবিশ্লিষ্ট করে মনোগ্লিসারাইড ও ফ্যাটি
এসিড উৎপন্ন করে। পরবর্তীতে তা ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারলে রূপান্তরিত হয়।
২. লিসিথিনেজ এনজাইম
লেসিথিনকে ফ্যাটি এসিড, গ্লিসারল, ফসফরিক এসিড ও কোলিনে পরিনত করে।
৩. মনোগ্লিসারাইডেজ
কোষের ভেতরে মনোগ্লিসারাইডকে ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারলে পরিনত করে।
এছাড়াও আন্ত্রিক গ্রন্থির
নিউক্লিয়েডেজ, নিউক্লিওটাইডেজ ও নিউক্লিওসাইডেজ এনজাইমসমূহ নিউক্লিক এসিড ও এর উপাদাসসমূহে
ফসফেট গ্রুপ, পেন্টোজ শ্যুগার ও নাইট্রোজেন বেস এ ভেঙ্গে দেয়।