বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল, ২০২১

মানব পরিপাকতন্ত্র আলোচনা পর্ব-২। মানুষের খাদ্য পরিপাক প্রণালী (Process of Human Digestion)

 মানুষের খাদ্য পরিপাক প্রণালী (Process of Human Digestion)

মানুষে অধিকাংশ খাদ্য (শর্করা, আমিষ ও স্নেহদ্রব্য) বৃহৎ অনু হিসেবে মুখগহ্বরে গৃহীত হয়। খাদ্যবস্তুর এ বৃহত্তর জটিল অনুগুলো ক্ষুদ্রতম অনুতে বিশ্লিষ্ট না হওয়া পর্যন্ত মানব দেহের কোন কাজে আসে না। সেজন্য শর্করা, আমিষ ও স্নেহদ্রব্য এ তিনটি খাদ্যের উপাদানকে পরিপাক করতে হয়। নিচে খাদ্য উপাদানের নাম, পরিপাক এনজাইম ও উৎপন্ন দ্রব্য ছক আকারে উপস্থাপন করা হলো।

খাদ্যের উপাদান

প্রধান এনজাইম

উৎপন্ন দ্রব্য

শর্করা

(ভাত, রুটি, চিনি, শাক-সবজি)

অ্যামাইলোলাইটিক এনজাইম

(টায়ালিন, অ্যামাইলেজ, মল্টেজ, সুক্রেজ)

গ্লুকোজ

আমিষ

(মাছ, মাংস, ডাল)

প্রোটিওলাইটিক এনজাইম

(পেপসিন, ট্রিপসিন, কাইমোট্রিপসিন, অ্যামিনোট্রিপসিন)

অ্যামিনো এসিড

স্নেহদ্রব্য

(ভোজ্যতেল, ঘি, মাখন, প্রাণিজ চর্বি)

লাইপোলাইটিক এনজাইম

(পাকস্থলীয় ও আন্ত্রিক লাইপেজ, ফসফোলাইপেজ, কোলেস্টেরল, এস্টারেজ, লেসিথিন)

ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারল

 


মানুষের পৌষ্টিকনালির বিভিন্ন অংশে শর্করা, আমিষ ও স্নেহদ্রব্যের পরিপাক সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ

মুখগহ্বরে খাদ্য পরিপাকঃ

মানুষের পৌষ্টিকনালি মুখ থেকে পায়ু পর্যন্ত বিস্তৃত এবং ৮-১০ মিটার লম্বা। পৌষ্টিকনালির শুরু মুখ থেকে। নাসাছিদ্রের নিচে অবস্থিত এক আড়াআড়ি ছিদ্র যা একটি করে উপরের ও নিচের ঠোঁটে বেষ্টিত থাকে। মুখছিদ্রের মাঝে খাদ্যবস্তু মুখগহ্বর বা মুখবিবরে প্রবেশ করে।

মুখপরবর্তী গহ্বরটি মুখবহ্বর। একে ঘিরে এবং এর ভিতরে কয়েকটি অঙ্গ অবস্থিত। এসব অঙ্গের মধ্যে গাল, দাঁত, মাড়ি, জিহ্বা ও তালু প্রধান।

মুখগহ্বরের উর্ধ্ব প্রচীর তালুর অস্থি ও পেশি দিয়ে সামনের প্রাচীল ঠোটের পেশি দিয়ে এবং পাশের প্রাচীর গালের পেশি নিয়ে গঠিত। তালুর অগ্রভাগ অস্থিনির্মিত ও শক্ত, পশ্চাৎভাগ পেশল ও নরম। কোমল তালুর পেছনের প্রান্তের মধ্যভাগ থেকে একটি পেশল আলজিহ্বা মুখগহ্বরে ঝুলে থাকে।

নিম্ন চোয়ালের অস্থির সাথে জিহ্বা যুক্ত থাকে। এর পৃষ্ঠতলে থাকে ফ্লাস্ক আকৃতির স্বাদকুড়ি। স্বাদকুড়িগুলো খাদ্যে অবস্থিত বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বস্তুর প্রতি সংবেদনশীল। যেমন- জিহ্বার অগ্রপান্তে মিষ্টি, অগ্রভাগের দুপাশে নোনা, পশ্চাৎভাগের দুপাশে টক এবং পেছন দিকে তিক্ত স্বাদ গ্রহন করে। পাচ-দশ দিনের মধ্যে খাদ্যের ঘসায় স্বাদকুড়ি নষ্ট বা ছিন্ন হয়ে যায় এবং প্রতিস্থাপিত হয়।



মানুষের মুখগহ্বরের দুপাশে তিনজোড়া লালাগ্রন্থি অবস্থিত। এগুলো হচ্ছে দুপাশের কানের নিচে প্যারোটিড গ্রন্থি, নিচের চোয়ালের ভিতর দিকে সাবম্যান্ডিবুলার গ্রন্থি এবং জিহ্বার তলায় সাবলিঙ্গুয়াল গ্রন্থি। গ্রন্থিগুলো রস ক্ষরণকারী এবং এপিথেলিয়ামে আবৃত গোল বা ডিম্বাকার থলি বিশেষ। থলির প্রাচীরে যে সেরাস কোষ ও মিউকাস কোষ রয়েছে তা থেকে রস ক্ষরিত হয়। লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালা কিছুটা অম্লীয় এবং এর অধিকাংশই পানি (৯৫.৫%)। একজন  সুস্থ মানুষ প্রতিদিন ১২০০-১৫০০ মিলিলিটার লালা ক্ষরণ করে।

মুখগহ্বরে খাদ্যবস্তু দুভাবে পরিপাক হয় যান্ত্রিক ও রাসায়নিক।

যান্ত্রিক পরিপাকঃ

·        সামান্যতম স্বাদ, গন্ধ ও খাদ্য গ্রহণে স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্ক যে সংকেত পায় তার প্রেক্ষিতে মস্তিষ্ক লালাগ্রন্থিগুলোতে লালা ক্ষরণের বার্তা পাঠায়। লালা মূলত পানিতে গঠিত এবং খাদ্যকে এমনভাবে নরম ও মসৃন করে যাতে দাতের কাজ দ্রুত ও সহজ হয়।

·        চার ধরনের দাত যেমন- ইনসিসর, ক্যানাইন, প্রিমোলার ও মোলার এর নানা ধরনের কর্মকান্ডের ফলে বড় খাদ্যখন্ড কাটা-ছেড়া, পেষণ-নিষ্পেষণ শেষে হজম উপযোগী ছোট ছোট টুকরায় পরিণত হয়।

·        জিহ্বা নড়াচড়া ও সংকোচন প্রসারণক্ষম পেশল অংশ। এটি স্বাদ নেওয়া ছাড়াও দাতে আটকে থাকা খাদ্যকনা সরাতে, মুখের চারপাশে ঘুরিয়ে বিভিন্ন দাতের নিচে পৌছাতে, লালা মিশ্রণে এবং সবশেষে গিলতে সাহায্য করে।

·        যান্ত্রিক পরিপাকের সময় খাদ্যখন্ড নিষ্পেষিত হয়ে নরম খাদ্যমন্ড তে পরিণত হয়। জিহ্বার উপরতল যখন খাদ্যমনএক শক্ত তালুর বিপরীতে রেখে চাপ দেয় তখন খাদ্যমন্ড পিছনে দিকে যেতে বাধ্য হয়।

·        পেছনে কোমল তালূ থাকায় খাদ্যপিন্ড নাসাছিদ্রপথে প্রবেশে বাঁধা পায়।

·        কোমল তালু পার হলেই খাবার গলবিলে এসে পৌছায়। গলবিল থেকে দুটি নালি চলে গেছে-একটি শ্বাসনালি অন্যটি অন্ননালি।

·        জিহ্বার গোড়ার দিকে শ্বাসনালির অংশে ছোট উদগত অংশ হিসেবে অবস্থিত আলজিহ্বা অন্ননালির উপর এমন এক উর্ধ্বগামী বলপ্রয়োগ করে যাতে চিবানো খাদ্য শ্বাসনালির ভিতর প্রবেশ না করে অন্ননালির ভিতর প্রবেশ করে।

রাসায়নিক পরিপাকঃ

শর্করা পরিপাক: লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালারসে টায়ালিন ও মল্টেজ নামে শর্করাবিশ্লেষী এনজাইম পাওয়া যায়। এগুলো জটিল শর্করাকে মল্টোজ এবং সামান্য মল্টোজকে গ্লুকোজে পরিণত করে। টায়ালিনের ক্রিয়া মুখগহ্বরে শুরু হলেও এর পরিপাক ক্রিয়া সংঘটিত হয় পাকস্থলিতে।

                           টায়ালিন                                             মল্টেজ                  

জটিল শর্করা                                          মল্টোজ                                           গ্লুকোজ

আমিষ পরিপাক: মুখগহ্বরের লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালারসে কোন প্রোটিওলাইটিক এনজাইম না থাকায় এখানে আমিষ জাতীয় খাদ্যের কোন রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটেনা।

স্নেহ পরিপাক: মুখগহ্বরে স্নেহজাতীয় খাদ্য পরিপাকের জন্য কোন এনজাইম না থাকায় এধরনের খাদ্যের পরিপাক ঘটেনা।

লালামিশ্রিত, চর্বিত ও আংশিক পরিপাককৃত শর্করা গলবিল ও অন্ননালির মাধ্যমে পাকস্থলিতে পৌছায়।

Share:

বুধবার, ২১ এপ্রিল, ২০২১

মানব পরিপাকতন্ত্র আলোচনা পর্ব-১

মানবদেহের বিভিন্ন জৈবনিক কাজ পরিচালনা, শক্তি সরবরাহ, দেহিক ও মানসিক বৃদ্ধি অব্যাহত রাখা এবং রোগজীবানুর আক্রমণ থেকে দেহকে রক্ষা করার প্রাথমিক প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে পুষ্টি। খাদ্য-ই মানবদেহে পুষ্টির যোগান দেয়। তবে মানুষ যেসব খাদ্য গ্রহণ করে থাকে তার অধিকাংশই দেহকোষের প্রোটোপ্লাজন শোষন করতে পারেনা। শরীরের কাজে লাগানোর জন্য বিভিন্ন এনজাইমের তৎপরতায় খাদ্য পরিপাক নামে এক বিশেষ জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিপাক হতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় খাদ্য প্রথমে সরল দ্রবনীয় অবস্থায় রূপান্তরিত হওয়ার পরে শরীরে প্রবেশের উপযোগী হয়। সবশেষে রক্ত এ পরিপাককৃত খাদ্যকে শরীরের বিভিন্ন অংশে সরবরাহ করে।



পরিপাকঃ

যে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জটিল খাদ্যবস্তু বিভিন্ন হরমোনের প্রভাবে ও এনজাইমের সহায়তায় দ্রবণীয় সরল ও তরল এবং দেহকোষের গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে তাকে পরিপাক (Digestion) বলে। যে তন্ত্রের সাহায্যে খাদ্যবস্তুর পরিপাক ও শোষণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় তাকে পৌষ্টিকতন্ত্র বলে।

পরিপাক প্রক্রিয়া কতগুলো ধারাবাহিক যান্ত্রিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

যান্ত্রিক পরিপাক: পরিপাকের সময় যে প্রক্রিয়ায় গৃহীত খাদ্যের পরিশোষিত অংশ চিবানো, গলাধঃকরণ ও পৌষ্টিকনালি অতিক্রমের সময় নালির বিভিন্ন অংশেল পেশল সঞ্চালনের ফলে খাদ্য ভাঙনের মাধ্যমে অতি ক্ষুদ্র টুকরায় পরিণত হয়ে এবং এনজাইমের ক্রিয়াতলের বৃদ্ধি পেয়ে সহজ ও সম্ভব করে তোলে তাকে যান্ত্রিক পরিপাক বলে।

রাসায়নিক পরিপাক: পরিপাকের সময় গৃহীত খাদ্যের পরিপাকযোগ্য অংশ পরিপাকের পরপরই মুখ, পাকস্থলি ও অন্ত্রে এসিড, ক্ষার ও এনজাইমের সহায়তায় রাসায়নিক ভাঙনের মাধ্যমে দেহকোষের গ্রহণোপযোগী উপাদানে পরিনত হওয়াকে রাসায়নিক পরিপাক বলে।

মানবদেহের পৌষ্টিকতন্ত্র পৌষ্টিকনালি এবং সংশ্লিষ্ট পৌষ্টিকগ্রন্থি নিয়ে গঠিত।

পৌষ্টিকতন্ত্র

 

 

 

পৌষ্টিকনালি

১. মুখছিদ্র

২. মুখগহ্বর

৩. গলবিল

৪. অন্ননালি

৫. পাকস্থলি

  ক. কার্ডিয়া

  খ. ফানডাস

  গ. বড় বাঁক

  ঘ. পাইলোরাস

  ঙ. ছোট বাঁক

৬. ক্ষুদ্রান্ত্র

  ক. ডিওডেনাম

  খ. জেজুনাম

  গ. ইলিয়াম

৭. বৃহদন্ত্র

  ক. সিকাম

  খ. কোলন

1)      উর্ধ্বমুখী

2)      অনুপ্রস্থ

3)      নিম্নমুখী

4)      সিগময়েড

 গ. মলাশয়

৮. পায়ু

 

 

পৌষ্টিকগ্রন্থি

১. লালাগ্রন্থি

২. যকৃত

৩. অগ্ন্যাশয়

৪. গ্যাস্ট্রিকগ্রন্থি

৫. আন্ত্রিকগ্রন্থি

 

 

 

মানুষের পৌষ্টিকনালিতে বিভিন্ন ধরনের জটিল খাদ্যের পরিপাক নিম্নোক্ত ৬টি ধাপে সম্পন্ন হয়।

১. খাদ্য ও পানি গলাধঃকরণ

২. খাদ্যের যান্ত্রিক পরিপাক

৩. খাদ্যের রাসায়নিক পরিপাক

৪. পৌষ্টিকনালিতে খাদ্যের সঞ্চালন

৫. পরিপাককৃত খাদ্য ও পানি পরিশোষণ

৬. বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন

মানুষ সর্বভুক প্রাণী। উদ্ভিদ ও প্রাণিজ উভয় ধরনের খাদ্যই এরা গ্রহণ করে থাকে। এদের খাদ্য তালিকায় ছয়টি খাদ্য উপাদানই রয়েছে। তবে শর্করা, আমিষ ও স্নেহজাতীয় খাদ্য জটিল হওয়ার কারনে এগুলো পরিপাকের প্রয়োজন হয়। বাকি তিনটে খাদ্যোপাদান, যেমন- ভিটামিন, খনিজ লবন ও পানি কোষে সরাসরি গৃহীত হওয়ায় এগুলো পরিপাকের প্রয়োজন হয় না। সঠিক পরিপাণ শর্করা, আমিষ, স্নেহদ্রব্য, ভিটামিন, খনিজ লবন ও পানি দিয়ে গঠিত যে খাদ্র কোনো ব্যক্তির স্বাভাবিক পুষ্টি ও প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে তাকে সুষম খাদ্য বলে। নিচে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ মানুষের সুষম খাদ্যের তালিকা প্রদান করা হলো।

খাদ্য উপাদান

পরিমাণ

প্রধান কাজ

১. শর্করা (Carbohydrate)

৪১৫-৬০০ গ্রাম

তাপশক্তি উৎপাদন ও দেহে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি।

২. আমিষ (Protein)

১০০-১৫০ গ্রাম

দেহের বৃদ্ধি, কোষগঠন, ক্ষয়পূরণ, এনজাইম ও হরমোন উৎপাদন।

৩. স্নেহদ্রব্য (Lipid)

৫০-৫৫ গ্রাম

তাপশক্তি উৎপাদন ও দেহের তাপ নিয়ন্ত্রণ।

৪. ভিটামিন (Vitamin)

৫৫০০-৫৬০০ মিলিগ্রাম

পুষ্টি ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করা এবং রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ায়।

৫. খনিজ লবণ (Mineral salts)

৮-১০ গ্রাম

স্বাভাবিক পুষ্টি ও বৃদ্ধিতে সহায়তা।

৬. পানি (Water)

২-৩ লিটার

প্রোটোপ্লাজমকে সিক্ত ও সজীব রাখ এবং কোষের বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা।


 


Share:

Clock

Facebook Page