মানুষের খাদ্য পরিপাক প্রণালী (Process of Human Digestion)
মানুষে অধিকাংশ খাদ্য
(শর্করা, আমিষ ও স্নেহদ্রব্য) বৃহৎ অনু হিসেবে মুখগহ্বরে গৃহীত হয়। খাদ্যবস্তুর এ বৃহত্তর
জটিল অনুগুলো ক্ষুদ্রতম অনুতে বিশ্লিষ্ট না হওয়া পর্যন্ত মানব দেহের কোন কাজে আসে না।
সেজন্য শর্করা, আমিষ ও স্নেহদ্রব্য এ তিনটি খাদ্যের উপাদানকে পরিপাক করতে হয়। নিচে
খাদ্য উপাদানের নাম, পরিপাক এনজাইম ও উৎপন্ন দ্রব্য ছক আকারে উপস্থাপন করা হলো।
খাদ্যের উপাদান |
প্রধান এনজাইম |
উৎপন্ন দ্রব্য |
শর্করা (ভাত, রুটি, চিনি, শাক-সবজি) |
অ্যামাইলোলাইটিক এনজাইম (টায়ালিন, অ্যামাইলেজ, মল্টেজ, সুক্রেজ) |
গ্লুকোজ |
আমিষ (মাছ, মাংস, ডাল) |
প্রোটিওলাইটিক এনজাইম (পেপসিন, ট্রিপসিন, কাইমোট্রিপসিন,
অ্যামিনোট্রিপসিন) |
অ্যামিনো এসিড |
স্নেহদ্রব্য (ভোজ্যতেল, ঘি, মাখন, প্রাণিজ চর্বি) |
লাইপোলাইটিক এনজাইম (পাকস্থলীয় ও আন্ত্রিক লাইপেজ, ফসফোলাইপেজ,
কোলেস্টেরল, এস্টারেজ, লেসিথিন) |
ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারল |
মানুষের পৌষ্টিকনালির
বিভিন্ন অংশে শর্করা, আমিষ ও স্নেহদ্রব্যের পরিপাক সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
মুখগহ্বরে খাদ্য পরিপাকঃ
মানুষের পৌষ্টিকনালি
মুখ থেকে পায়ু পর্যন্ত বিস্তৃত এবং ৮-১০ মিটার লম্বা। পৌষ্টিকনালির শুরু মুখ থেকে।
নাসাছিদ্রের নিচে অবস্থিত এক আড়াআড়ি ছিদ্র যা একটি করে উপরের ও নিচের ঠোঁটে বেষ্টিত
থাকে। মুখছিদ্রের মাঝে খাদ্যবস্তু মুখগহ্বর বা মুখবিবরে প্রবেশ করে।
মুখপরবর্তী গহ্বরটি
মুখবহ্বর। একে ঘিরে এবং এর ভিতরে কয়েকটি অঙ্গ অবস্থিত। এসব অঙ্গের মধ্যে গাল, দাঁত,
মাড়ি, জিহ্বা ও তালু প্রধান।
মুখগহ্বরের উর্ধ্ব প্রচীর
তালুর অস্থি ও পেশি দিয়ে সামনের প্রাচীল ঠোটের পেশি দিয়ে এবং পাশের প্রাচীর গালের পেশি
নিয়ে গঠিত। তালুর অগ্রভাগ অস্থিনির্মিত ও শক্ত, পশ্চাৎভাগ পেশল ও নরম। কোমল তালুর পেছনের
প্রান্তের মধ্যভাগ থেকে একটি পেশল আলজিহ্বা মুখগহ্বরে ঝুলে থাকে।
নিম্ন চোয়ালের অস্থির
সাথে জিহ্বা যুক্ত থাকে। এর পৃষ্ঠতলে থাকে ফ্লাস্ক আকৃতির স্বাদকুড়ি। স্বাদকুড়িগুলো
খাদ্যে অবস্থিত বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বস্তুর প্রতি সংবেদনশীল। যেমন- জিহ্বার অগ্রপান্তে মিষ্টি, অগ্রভাগের দুপাশে
নোনা, পশ্চাৎভাগের দুপাশে টক এবং পেছন দিকে তিক্ত স্বাদ গ্রহন করে। পাচ-দশ দিনের
মধ্যে খাদ্যের ঘসায় স্বাদকুড়ি নষ্ট বা ছিন্ন হয়ে যায় এবং প্রতিস্থাপিত হয়।
মানুষের মুখগহ্বরের
দুপাশে তিনজোড়া লালাগ্রন্থি অবস্থিত। এগুলো হচ্ছে দুপাশের কানের নিচে প্যারোটিড গ্রন্থি,
নিচের চোয়ালের ভিতর দিকে সাবম্যান্ডিবুলার গ্রন্থি এবং জিহ্বার তলায় সাবলিঙ্গুয়াল গ্রন্থি।
গ্রন্থিগুলো রস ক্ষরণকারী এবং এপিথেলিয়ামে আবৃত গোল বা ডিম্বাকার থলি বিশেষ। থলির প্রাচীরে
যে সেরাস কোষ ও মিউকাস কোষ রয়েছে তা থেকে রস ক্ষরিত হয়। লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালা
কিছুটা অম্লীয় এবং এর অধিকাংশই পানি (৯৫.৫%)। একজন সুস্থ মানুষ প্রতিদিন ১২০০-১৫০০
মিলিলিটার লালা ক্ষরণ করে।
মুখগহ্বরে খাদ্যবস্তু
দুভাবে পরিপাক হয় যান্ত্রিক ও রাসায়নিক।
যান্ত্রিক পরিপাকঃ
·
সামান্যতম স্বাদ, গন্ধ ও খাদ্য গ্রহণে স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্ক
যে সংকেত পায় তার প্রেক্ষিতে মস্তিষ্ক লালাগ্রন্থিগুলোতে লালা ক্ষরণের বার্তা পাঠায়।
লালা মূলত পানিতে গঠিত এবং খাদ্যকে এমনভাবে নরম ও মসৃন করে যাতে দাতের কাজ দ্রুত ও
সহজ হয়।
·
চার ধরনের দাত যেমন- ইনসিসর, ক্যানাইন, প্রিমোলার ও মোলার এর নানা
ধরনের কর্মকান্ডের ফলে বড় খাদ্যখন্ড কাটা-ছেড়া, পেষণ-নিষ্পেষণ শেষে হজম উপযোগী ছোট
ছোট টুকরায় পরিণত হয়।
·
জিহ্বা নড়াচড়া ও সংকোচন প্রসারণক্ষম পেশল অংশ। এটি স্বাদ নেওয়া
ছাড়াও দাতে আটকে থাকা খাদ্যকনা সরাতে, মুখের চারপাশে ঘুরিয়ে বিভিন্ন দাতের নিচে পৌছাতে,
লালা মিশ্রণে এবং সবশেষে গিলতে সাহায্য করে।
·
যান্ত্রিক পরিপাকের সময় খাদ্যখন্ড নিষ্পেষিত হয়ে নরম খাদ্যমন্ড
তে পরিণত হয়। জিহ্বার উপরতল যখন খাদ্যমনএক শক্ত তালুর বিপরীতে রেখে চাপ দেয় তখন খাদ্যমন্ড
পিছনে দিকে যেতে বাধ্য হয়।
·
পেছনে কোমল তালূ থাকায় খাদ্যপিন্ড নাসাছিদ্রপথে প্রবেশে বাঁধা
পায়।
·
কোমল তালু পার হলেই খাবার গলবিলে এসে পৌছায়। গলবিল থেকে দুটি নালি
চলে গেছে-একটি শ্বাসনালি অন্যটি অন্ননালি।
·
জিহ্বার গোড়ার দিকে শ্বাসনালির অংশে ছোট উদগত অংশ হিসেবে অবস্থিত
আলজিহ্বা অন্ননালির উপর এমন এক উর্ধ্বগামী বলপ্রয়োগ করে যাতে চিবানো খাদ্য শ্বাসনালির
ভিতর প্রবেশ না করে অন্ননালির ভিতর প্রবেশ করে।
রাসায়নিক পরিপাকঃ
শর্করা পরিপাক: লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালারসে টায়ালিন ও
মল্টেজ নামে শর্করাবিশ্লেষী এনজাইম পাওয়া যায়। এগুলো জটিল শর্করাকে মল্টোজ এবং সামান্য
মল্টোজকে গ্লুকোজে পরিণত করে। টায়ালিনের ক্রিয়া মুখগহ্বরে শুরু হলেও এর পরিপাক ক্রিয়া
সংঘটিত হয় পাকস্থলিতে।
টায়ালিন মল্টেজ
আমিষ পরিপাক: মুখগহ্বরের লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালারসে
কোন প্রোটিওলাইটিক এনজাইম না থাকায় এখানে আমিষ জাতীয় খাদ্যের কোন রাসায়নিক পরিবর্তন
ঘটেনা।
স্নেহ পরিপাক: মুখগহ্বরে স্নেহজাতীয় খাদ্য পরিপাকের জন্য কোন
এনজাইম না থাকায় এধরনের খাদ্যের পরিপাক ঘটেনা।
লালামিশ্রিত, চর্বিত
ও আংশিক পরিপাককৃত শর্করা গলবিল ও অন্ননালির মাধ্যমে পাকস্থলিতে পৌছায়।